সাহিত্য মিস্টসিজম্ (Mysticism)
সাহিত্য মিস্টিসিজম্ (Mysticism)
সাহিত্যে মানুষের জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে ধ্যানধারণা রূপ-পরিগ্রহ করিয়া কায়াকান্তিময় হইয়া উঠে, ইহা স্বতঃসিদ্ধরূপে পরিগণিত। সাহিত্যিক জীবন ও জগতের রূপ-সৌষম্য দান করিতে সাধারণত বুদ্ধি বা অনুভূতির আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় যে, তিনি ইন্দ্রিয় বা মনের সাহায্যে সত্যের গুহাহিত মর্মটি উদ্ঘাটন করিয়া উঠিতে পারেন না-বার বার করিয়া তাঁহার 'কাঙাল নয়ন' সত্যদীপ্তির নিকট হইতে ফিরিয়া আসে, তাঁহার পঞ্চেন্দ্রিয় তাঁহাকে ব্যর্থতায় বিমূঢ় করিয়া দেয়, এবং তাঁহার মনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কল্পনা সেই তুরীয় মার্গে উপনীত হইতে পারে না। অথচ, অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে যে সত্য-শিহরণ তিনি উপলব্ধি করেন, তাহার সত্যতা-বিচার জ্ঞানে নয়,
বুদ্ধিতে নয়, মেধায় নয়, প্রজ্ঞায় নয়, বোধিতে (Intution)। মিস্টিক সীমার মধ্য হইতে সীমাহীন অপরূপের স্বাদ গ্রহণ করিয়া অনুভব করেন-
হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি'
জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি।
এবং তিনি উপলব্ধি করেন-
সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কহিবারে,
বলিতে না পারে স্পষ্ট করি'।
মিস্টিকের ভাষা জ্ঞানীর বা ভাবুকের ভাষা নহে, ইঁহার ভাষাকে আমরা 'সন্ধ্যা ভাষা' বা 'আলো- আঁধারি ভাষা' নামে আখ্যাত করিতে পারি। কবি বিশেষ রূপবন্ধ (image), উপমা (Simile বা Metaphor) ও প্রতীকের (Symbol)) সাহায্যে অবাত্মানসগোচর সেই সত্তাকে গোধুলি-আলো- পরিম্লান রহস্যাচ্ছন্ন ভাষায় আমাদের নিকট উপস্থাপিত করেন। সত্যকে, সমুচ্চকে মানুষ যে ধরিতে চাহে, পাইতে চাহে এবং উহার সহিত অভিন্নতা সৃষ্টি করিয়া একান্ত হইতে চাহে, ইহা মনের সংযোগে নহে, বুদ্ধির সংযোগে নহে-বোধিদৃষ্টির ফলেই সম্ভব হইতে পারে। এই দৃষ্টিসম্ভূত অনুভূতি এক প্রকার প্রাতিভ জ্ঞান-কাল ও ব্যাপ্তির অতীত এক প্রকার দিব্যানুভূতি-
বিচিত্র এ মত্তদশা,
ভাবভরে যোগে বসা, হৃদয়ে উদার জ্যোতি কি বিচিত্র জ্বলে।
এই দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন কবি তর্ক করেন না, যাচাই করেন না, পরীক্ষা করেন না, বরং সত্যকে অপরোক্ষ করেন বলিয়া তৎক্ষণাৎ তাহাকে বিশ্বাস করেন, গ্রহণ করেন। বিচারের দ্বারা, জ্ঞানের দ্বারা পরমপুরুষ ও কবির মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি হয়; এইজন্যই বিচারের
অতীত বোধিদষ্টির সাহায্যে কবি নিজেকে পরম সত্তার সহিত একীভূত করিয়া অনভব করেন। মিস্টিক কবি বিশ্বজগৎ ও আত্মজগতের মধ্যে কোন দ্বন্দুকেই স্বীকার করেন না; বিশ্ব ও আত্মজগৎ যেন একটি সুষম, সঙ্গতিপূর্ণ, পরম সমন্বিত অখণ্ড সত্যরূপে তাঁহার কাছে প্রতিভাত। ভগবান তাঁহার কাছে পৃথক বস্তুসত্তা নহে; ভগবৎ অনুভূতিও যেন তাঁহার ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা-প্রসূত আত্মদর্শন মাত্র। কবি যখন এইরূপ একটি অখণ্ড চিন্ময়লোকে উপনীত হন, তখন তিনি ভোক্তা নহেন, রূপ-পূজারী নহেন, দ্রষ্টাও নহেন-ভাবলোকে উত্তীর্ণ এক বিদেহী বিশ্ব-চৈতন্য। কাজেই ব্যক্তি ও বস্তুর বিভিন্নতা তখন তাঁহার বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। এই সমাধি-অবস্থাতে ওয়ার্ডসওয়ার্থ যেমন 'centrel peace at the heart of things' অনুভব করিয়াছেন, রবীন্দ্রনাথও তেমন বিশ্বের চির-চলিষ্ণুতার মধ্যে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন-
স্থির আছে শুধু একটি বিষ্ণু,
ঘূর্ণির মাঝখানে।
কোন কাব্যে উপমা প্রভৃতি ব্যবহৃত হইলেই উহা মিস্টিক গুণসম্পন্ন হয় না। কিন্তু কবি যখন জগৎ ও জীবন-রহস্যের অদৃষ্টপূর্ব সৌন্দর্যের সম্মুখে বিস্ময়-বিমূঢ় হইয়া নির্বাক হইয়া পড়েন, তখন তাঁহার প্রাণের ভায়া যেন সহজেই প্রতীকের আশ্রয় গ্রহণ করে-টেনিসনের মতো সহজ সরল স্বচ্ছ চিন্তাপ্রধান কবিও 'সূর্যাস্ত ও সন্ধ্যাতারা' এবং 'জগৎ পারের করুণ আর্তনাদের' সাহায্যে কী এক অপরিচিত বা অর্ধ-পরিচিত রহস্য-বিস্ময়কে যেন ইঙ্গিত করেন। 'খেয়া' কাব্যের নামটিই যেমন রবীন্দ্রকাব্যে তট-পরিবর্তনের 'প্রতীক' রূপে ব্যবহৃত হইয়াছে, শেলীর জীবনালেখ্যও তেমন বিচিত্র সুন্দর গুম্বজ রূপে প্রতীকিত হইয়াছে-
Life, like a dome of many-coloured glass,
Stains the white radiance of eternity.
'প্রতীক' এইভাবে আমাদের কাছে (১) কাব্যের বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করে, (২) কবির অনুভূত সত্যকে প্রত্যয়-সত্যতা দান করে, (৩) বাস্তব-জীবনের কঠিনতা হইতে কবির মুক্তি-পিপাসা ইঙ্গিত করে, (৪) কবির অত্যন্ত ব্যক্তিগত (esoteric) অভিজ্ঞতার বাণীকে কাব্যশ্রী দান করে, এবং (৫) কাব্যদেহের প্রসাধন-রচনায় সহায়তা করে।"
সাহিত্যে প্রতীকের ব্যবহার সুপ্রাচীনকাল হইতেই চলিয়া আসিয়াছে। বাইবেলের গল্পগুলিতে, মেটারলিঙ্কের নাটকে এবং আধুনিককালে ঠাকুর রামকৃষ্ণের উপদেশাবলীতে ইহাদের প্রচুর দৃষ্টান্ত আছে। ইংরেজি সাহিত্যে Anglo-Saxon যুগের The Phoenix, মধ্যযুগের Pearl, Piers Plowman, চসারের Romaunt of the Rose, Parliament of Fowls, সপ্তদশ শতাব্দীতে Dryden-এর Absalom and Achitophol-এ, এবং পরবর্তীকালে Gulliver's Travels, Erewhon, The Coming and Passing of Arthur, Crossing the Bar প্রভৃতিতে ইহার ব্যবহার সুস্পষ্ট। বাংলা সাহিত্যেও, ঊনবিংশ শতাব্দীর বহু পূর্বে বাউল সঙ্গীতে (যথা, খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কমনে আসে যায়, ধরতে পারলে মনোবেড়ী দিতেম ইহার পায়) এবং দেহতত্ত্বমূলক সঙ্গীতে (যথা, কলের গাড়ী চলছে কি বাহার, কলের গাড়ী মানবদেহ), রামপ্রসাদের গানে (যথা, মা আমায় ঘুরাবি কত...). হেমচন্দ্রের 'দশমহাবিদ্যায়', দ্বিজেন ঠাকুরের 'স্বপ্ন-প্রয়াণে' রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর, রাজা, রক্তকরবী প্রভৃতি নাটকে ইহার প্রয়োগ দৃষ্ট হয়।
রোমান্টিক বা কল্পনা-বিলাসী কবি যাহাকে বিস্ময়-বিমূঢ় দৃষ্টিতে সমুজ্জ্বল করিয়া দেখেন, মিস্টিক তাহাকে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে সমাহিত-সান্ধ্য-সৌন্দর্যে অনুভব করেন। এই অনুভূতির মধ্যে আত্মবোধের পীড়ন নাই, আত্মাহুতির 'আকুল শান্তি ও বিপুল বিরতি' আছে। সুতরাং যে-অখণ্ড দৃষ্টির সাহায্যে কবি ভগবৎ সত্তা, তথা বিশ্ব-সৃষ্টির পরম সত্যকে উপলব্ধি করিয়া তাঁহার সহিত একাত্মতার পরম আনন্দ লাভ করিতে পারেন, সাহিত্যে সেই বোধি-দৃষ্টি-সাধনাকে আমরা মিস্টিসিজম্ নামে অভিহিত করিতে পারি। বলাবাহুল্য, ইহা কোন মতবাদ নহে, সত্যানুভূতির দৃষ্টি-প্রদীপ মাত্র। বোধিদৃষ্টি বশতই দেহতত্ত্ববিদ ভক্ত বাউল-কবি গাহিয়াছেন-
দেল দরিয়া খবর কররে মন।
তোর কোথা বৃন্দাবন, কোথা নিধুবন, কোথায় রে তোর গুরুর আসন। যদি পদ্মা পারি দিবি, তবে ঢাকা দেখতে পারি,
মুখসুধাবাদ করবে অন্বেষণ।
আছে কলিতে কলিকাতা, তিন সহরে আটা,
সাঁতার দে যায় রসিক যেন জন।"
এবং এই দৃষ্টিবলেই ব্লেক্ পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করেন-
If they (angels) see any weeping
That should have been sleeping.
They pour sleep on their head,
And sit down by their bed. যে প্রেমদৃষ্টি বলে 'গৃহিণী, ভগিনী ও দেবীরূপে' ইংরেজ কবি তাঁহার প্রেমিকার পূজা করিতে পারেন,
তাহা অপেক্ষা উচ্চতর দিব্যদৃষ্টিবলে বৈষ্ণব-কবি চন্ডীদাস তাঁহার প্রেমিকা-বন্দনায় গাহিতে পারেন-
তুমি রজকিনী
আমার রমণী
তুমি হও মাতৃপিতৃ
ত্রিসন্ধ্যা যাজন তোমারি ভজন
তুমি বেদমাতা গায়ত্রী।
বিহারীলালের প্রেমারতি আরও সুগভীর ধ্যানদৃষ্টি-সম্ভূত-
কে তুমি জননী পিতা,
নন্দিনী, রমণী, মিতা,
প্রেম-ভক্তি-স্নেহ-রস-উদার-উচ্ছ্বাস
কে তুমি মা জলস্থল,
মহান অনিলানল,
নক্ষত্র-খচিত নীল অনন্ত আকাশ?
কে তুমি? কে তুমি এই বিরাট বিকাশ?
ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রকৃতিপূজায় তপোমগ্ন দৃষ্টিবলে বিশ্ব-প্রকৃতির মধ্যে এক অখণ্ড হৃদয়-নন্দিনীকে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন-
And I have felt
A presence ..........
A motion and a spirit, that impels
All thinking things, all objects of all thought. And rolls through all things.
প্রকৃতি-বন্দনায় রবীন্দ্রনাথ মিস্টিকদৃষ্ট বলেই প্রকৃতির মধ্যে সুন্দরের আবাহন করিতেছেন- হে গগনের নীল শতদলখানি।
মেলিল নীরব বাণী।
অরুণ-পক্ষ প্রসারি সকৌতুকে
সোনার-ভ্রমর আসিল তাহার বুকে
কোথা হ'তে নাহি জানি।
যে-দৃষ্টিতে বৈষ্ণবকবি সমস্ত বিশ্বকে এক রাধা-ধাতুতে গঠিত দেখিয়াছেন, তাহার অনুরূপ দৃষ্টি- আলোকেই শেলী বিশ্বসৃষ্টিকে এক অখণ্ড সৌন্দর্য-ধাতু রূপে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন-
And my spirit.. Interpenetrated lie By the glory of the sky: Be it love, light, harmony. Odour, or the soul of all Which from Heaven like dew doth fall. Or the mind which feeds this verse Peopling the lone universe. রবীন্দ্রনাথও সমন্বয়ী-দৃষ্টির আলোকে সৌন্দর্যপূজা সমাপন করিয়াছেন- জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে
অন্তর মাঝে শুধু তুমি একা একাকী
তুমি বিচিত্ররূপিনী
তুমি অন্তর-ব্যাপিনী।
একটি স্বপ্ন-মুগ্ধ সজল নয়নে, একটি পদ্ম হৃদয়-বৃত্ত-শয়নে, একটি চন্দ্র অসীম চিত্ত-গগনে,
চারিদিকে চির-যামিনী। ইংরেজি সাহিত্যে Walter De La Mare পরিপূর্ণ মিস্টিক দৃষ্টিসম্পন্ন নহেন। তিনি The Listeners কবিতায় যে অলৌকিক সৌন্দর্যসৃষ্টি করিয়াছেন, উহা যেন নেহাৎ খেয়ালি-কল্পনা-প্রসূত মাত্র। বরং Yeats-এর কবিতায় মিস্টিক দৃষ্টি আরও গভীর। তাঁহার The Land of the Heart's Desire এবং The Shadowy Waters-ই তাহার প্রমাণ। A.E. যেন স্তিমিত গোধূলি-সৌন্দর্যে জীবনকে দেখিতে চাহেন-ফলে, তিনি বিশ্ব-রহস্যকে, পরমপিতা পরমেশ্বরের অস্তিত্বকে, এক অনির্বচনীয় জ্যোতির্ময় সঙ্গতির মধ্যে অনুভব করেন-
When the breath of twilight blows to flame the misty skies, All its vaporus sapphire, violent glow and silver gleam With their magic flood me through the gateway of the eyes; I am one with the twilight's dream.
-The Unknown God.