মানবিকতা, আইন এবং রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা
![]() |
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। ছবি: সংগৃহীত |
যদি কেহ বলেন, ব্যাটারি চালিত রিকশার শ্রমজীবী চালকগণ আইনত অপরাধে লিপ্ত, তাহা হইলেও তাহাদের পরিবারভুক্ত অবুঝ সন্তানগণ তো অপরাধী নহে। ক্ষুধার্ত পেটে পিতা কখন বাড়ি ফিরিবেন, এই অপেক্ষায় প্রহর গুণিয়া যেসব শিশু দিন কাটায়, তাহাদের দোষ কী? তাহাদের পাপ কোথায়?
রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের উচিত ছিল এই মানবিক দিকসমূহ গভীর সহানুভূতির সহিত বিবেচনায় লওয়া। কিন্তু দেখা গিয়াছে, কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ও পুনর্বাসনের নিশ্চয়তা ব্যতিরেকে একতরফাভাবে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হইয়াছে, যাহার ফলে হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ জীবিকা হারাইয়া পড়িয়াছেন চরম দুর্দশায়। অনেকেই প্রায় পথে বসিয়া গিয়াছেন। যাঁহারা দৈনিক আয়ের উপর নির্ভরশীল, হঠাৎ জীবিকার এই বিপর্যয়ে তাহারা হইয়াছেন নিঃস্ব ও দিশাহীন।
রাষ্ট্র যদি কোনো পেশা নিষিদ্ধ করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাহা হইলে সেই পেশাজীবীদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের পথও রাষ্ট্রেরই নিশ্চিত করিবার দায়িত্ব। কেবলমাত্র আইনানুগতার দোহাই দিয়া হাজার হাজার পরিবারকে বিপন্ন করিয়া দেওয়া কোনো বিবেচনাতেই ন্যায়সঙ্গত নহে। উন্নয়ন যদি মানুষের জীবনকে অন্ধকারে নিপতিত করে, তবে তাহা উন্নয়ন নহে—তাহা নিষ্ঠুরতা মাত্র।
অতএব, আমরা রাষ্ট্রের নিকট উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানাই—শ্রমজীবী মানুষকে অপরাধী বলিয়া দৃষ্টিতে না দেখিয়া, তাহাদের সৃষ্টিশীল নাগরিক বলিয়া পুনর্বাসনের সুযোগ প্রদান করা হউক। যেন তাহাদের সন্তানগণ ক্ষুধার্ত পেটে পিতার প্রতীক্ষা না করিয়া আত্মমর্যাদার সহিত শৈশব যাপন করিতে পারে। এই হউক মানবিক উন্নয়নের প্রকৃত চিহ্ন।
ইহা শুধু ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা-চালকদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নহে। নগরের রাজপথে যেসব হকার, ফুটপাথ জুড়ে থাকা অবৈধ দোকানপাট, ফিটনেসবিহীন যানবাহন এবং চলাচলের নামে বিশৃঙ্খলার যে অবাধ প্রবাহ দেখা যায়, তাহা গোটা যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলিয়া দিয়াছে। এ অবস্থার নিরসনে প্রয়োজন সুপরিকল্পিত, যুগোপযোগী এবং অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনীতি।
যোগাযোগ ব্যবস্থা কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য নহে। ইহা জাতির সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের নিকট একটি মৌলিক নাগরিক অধিকার। এই অধিকারের সুরক্ষায় রাষ্ট্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে যে দুর্ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়, তাহা সভ্য কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থায় অনুমেয় নয়।
দারিদ্র্য ও ধনসম্পদের ভিত্তিতে যাতায়াতের অধিকার ভাগ করিলে কখনোই সুশৃঙ্খল যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হইবে না। রাষ্ট্রের প্রয়োজন সাহসী ও কঠোর অবস্থান—যাহাতে ধনী ও দরিদ্র সকলেই আইন মানিয়া চলিতে বাধ্য হয়। রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে কোনো কোনো সময় ব্যক্তিগত স্বার্থের পরিপন্থী সিদ্ধান্তও গ্রহণ করিতে হইবে। ইহা হইল নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব, এবং রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের কর্তব্য।
একইসাথে, যাহারা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছেন, তাহাদের জন্য সহায়তাপূর্ণ পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ করাও আবশ্যক। যদি সরকার একটুখানি সহযোগিতার হাত বাড়াইয়া দেন, তবে মানুষ আপনিই বিকল্প কর্মজীবন গ্রহণ করিতে প্রণোদিত হইবে। এভাবেই গঠিত হইবে এক সুশৃঙ্খল, মানবিক, উন্নয়নমুখী এবং কল্যাণপ্রবণ রাষ্ট্রব্যবস্থা।
অপু চন্দ্র বর্মন
রুহিয়া, ঠাকুরগাঁও
১৪ মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ।