বিসর্জন — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মূলবক্তব্য: নাটকের মূল বক্তব্য আবর্তিত হয়েছে ধর্মভিত্তিক অর্থহীন সংস্কারের সঙ্গে হৃদয় ধর্মের সংঘাত, যুক্তিহীন প্রথার সঙ্গে মানব ধর্মের সংঘাত এবং ধর্মীয় অনাচারের সঙ্গে উদার মনুষ্যত্বের সংঘাতকে কেন্দ্র করে। ধর্মের অপব্যাখ্যার বীভৎস রূপ দেখে রবীন্দ্রনাথ 'বিসর্জন' নাটকে উচ্চারণ করেছিলেন, 'দেবতার নামে মনুষ্যত্ব হারায় মানুষ। নাটকের চরিত্র — গোবিন্দমাণিক্য— ত্রিপুরার রাজা নক্ষত্ররায়— গোবিন্দমাণিক্যের কনিষ্ট ভ্রাতা রঘুপতি— রাজপুরোহিত জয়সিংহ — রঘুপতির পালিত রাজপুত যুবক, রাজমন্দিরের সেবক চাঁদপাল — দেওয়ান নয়নরায়— সেনাপতি ধ্রুব — রাজপালিত বালক মন্ত্রী— পৌরগণ গুণবতী— মহিষী অপর্ণা— ভিখারিনী কাহিনিঃ নাটকের শুরুতেই অপর্ণা পূজায় আসীন রাজার কাছে বিচার প্রার্থনা করল যে তার ছাগ শিশু কেড়ে নিয়ে গেছে বলি দেবার উদ্দেশ্যে। রাজা জিজ্ঞাসা করলেন অপর্ণার ছাগশিশু কে কেড়ে নিয়েছে? অপর্ণা উত্তর দিল-- রাজ-ভৃত্য তব। রাজ-মন্দিরের পূজা। বলির লাগিয়া নিয়ে গেছে। এমন সময়ে জয়সিংহ উপস্থিত হলেন। রাজা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে এ বালিকার মনে বেদনা দিয়ে তার ছাগশিশু কেড়ে আনা হয়েছে, জয়সিংহ দেবতার প্রতি একান্ত বিশ্বাসী, আবার অপর দিকে উদার-স্বভাব। তিনি অপর্ণার বেদনা ও মহারাজের আগ্রহ দেখে বললেন- মহারাজ, আপনার প্রাণ-অংশ দিয়ে, যদি তারে বাঁচাইতে পারিতাম, দিতাম বাঁচায়ে। অপর্ণা ও জয়সিংহ প্রস্থান করলেন। পরে জয়সিংহ ফিরে এসে রাজাকে সংবাদ দিলেন যে অপর্ণার ছাগ আর পাওয়া যাবে না, মা তারে নিয়েছেন। এ কথা শুনে অপর্ণা তীব্র প্রতিবাদ করে বলল-- মা তাহারে নিয়েছেন? মিছে কথা। রাক্ষসী নিয়েছে তারে! অপর্ণা-বলে দিল যে মাতার ধর্ম মমতা, করুণা; আর রাক্ষসীর ধর্ম হিংসা; অতএব যে রক্তলোলুপ, সে রাক্ষসী নয় তো কি! অপর্ণার কথা শুনে জয়সিংহের সংস্কার ও হৃদয়ধর্মের দ্বন্দ্ব উপস্থিত হল— করুণায় কাঁদে প্রাণ মানবের,--দয়া নাই বিশ্বজননীর! জয়সিংহের ব্যথিত মনের পরিচয় পেয়ে অপর্ণার মনে তার প্রতি ভালবাসা- সঞ্চার হলো। জয়সিংহ অপর্ণার ভালবাসার আহবানে এক অভিজ্ঞতার আস্বাদ পেলেন। তার অন্ধভক্তি অপর্ণার প্রেমের স্পর্শে ব্যাকুল হল। তোমার মন্দিরে এ কী নূতন সঙ্গীত ধ্বনিয়া উঠিল আজি হে গিরিনন্দিনী, তিনি পাষাণ-প্রতিমায় আর চিত্তের আশ্রয় পাচ্ছেন না! সেজন্য তিনি জিজ্ঞাসা করলেন-- কোথায় আশ্রয় আছে?এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন গোবিন্দমাণিক্য--যেথা আছে প্রেম! প্রথম অঙ্কের মহারাণী গুণবতী দেবী-মন্দিরে দেবীকে মাতৃ-সম্বোধন করে নিজের মাতৃত্বের প্রবল আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করলেন। তিনি রাজরাণী স্বামী-সোহাগিনী, কিন্তু সন্তানহীনা। কুমার-জননী মাত:, কোন্ পাপে মোরে করিলি বঞ্চিত মাতৃস্বর্গ হতে? দেবীর পূজক রঘুপতি এসে উপস্থিত হলেন। রঘুপতি বললেন,--মায়ের মহিমা কে বুঝতে পারে। গুণবতী বললেন-- করিনু মানৎ, মা যদি সন্তান দেন, বর্ষে বর্ষে দিব তাঁরে একশ মহিষ, তিন শত ছাগ! একদিন রাজা গোবিন্দমাণিক্য এসে সভায় প্রবেশ করলেন, সঙ্গে রঘুপতি ও নক্ষত্ররায়ও আসলেন। সকলে রাজাকে অভ্যর্থনা করল, কিন্তু রঘুপতি দাম্ভিক, তিনি রাজাকে আশীর্বাদ না করে নিজের বক্তব্য প্রকাশ করলেন— রাজার ভাণ্ডারে এসেছি বলির পশু সংগ্রহ করতে। রাজা বলি নিষেধ করার উদ্দেশ্যেই রাজসভায় এসেছিলেন, রঘুপতির প্রার্থনা তৎক্ষণাৎ রাজাকে সে সুযোগ দিল, তিনি বলি-নিষেধের আজ্ঞা প্রচার করলেন। রাজা বললেন,--এ আদেশ স্বপ্ন নয়, দেবী স্বয়ং বালিকার মূর্তি ধরে এসে তার সত্যদৃষ্টি উন্মোচন করে দিয়েছেন। রঘুপতি বললেন, শাস্ত্রবিধি তোমার অধীন নয়, গোবিন্দমাণিক্য বলল, সকল শাস্ত্রের বড় দেবীর আদেশ, রঘুপতির অহঙ্কারে আঘাত লাগল, তিনি বললেন--আমি দেবীর পূজক, ব্রাহ্মণ, আমি শুনলাম না দেবীর আদেশ, আর তুমি শুনতে পেলে! এ কেবল ভ্রান্তি নয়, অহঙ্কারও! রঘুপতি রেগে রাজাকে পাষণ্ড, নাস্তিক বলতে লাগলেন। কিন্তু রাজা তাতে বিচলিত না হয়ে আদেশ প্রচার করলেন- যে করিবে জীব-হত্যা জীব-জননীর পূজাচ্ছলে, তার দিব নির্বাসন দণ্ড! মন্দিরে জয়সিংহ একাকী দেবী-প্রতিমাকে সম্বোধন করে বলছেন--দেবীর কাছে থেকেও তার কেন একা বলে মনে হচ্ছে। রঘুপতি মন্দিরে আসলে তার ক্ষোভের কারণ কি তা জিজ্ঞাসা করলেন। রঘুপতি উত্তরে বললেন,--রাজা গোবিন্দমাণিক্য তাকে অপমান করেছেন। রাজার আদেশ শুনে প্রতিজ্ঞা করলেন-- যতদিন প্রাণ আছে, অসম্পূর্ণ নাহি রবে জননীর পূজা। অন্ত:পুর। মহারাণী গুণবতীকে পরিচারিকা এসে সংবাদ দিল যে রাণীর পূজা মন্দির হতে ফিরে এসেছে। কার এত বড় স্পর্ধা যে রাণীর পূজা মন্দির হতে ফিরে দিতে সাহস করে! পরিচারিকা ভয়ে রাজার নাম বলতে পারল না। তখন মহারাণী রঘুপতিকে ডেকে পাঠালেন। এমন সময় গোবিন্দমাণিক্য আসলেন। রাণী রেগে রাজাকে জিজ্ঞাসা করলেন—কে সে দু:সাহসী যে তার পূজা ফিরিয়ে দিয়েছে? রাজা নম্রভাবে স্বীকার করিলেন যে সেই অপরাধী। তখন স্বামীর প্রতি অভিমান তাকে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তুলল। রঘুপতি রাণীকে ভয় দেখাইবার জন্য অভিসম্পাত দিলেন যে বলি নিষিদ্ধ করার ফলে রাজমহিমা— হয়ে যাবে ধূলিসাৎ বজ্রদীর্ণ দগ্ধ ...। রঘুপতি সেনাপতি নয়নরায়কে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তোলার জন্য তাকে অনেক প্ররোচনা দিতে লাগলেন, কিন্তু সেনাপতি রাজভক্ত, তিনি বিশ্বাসহন্তা হতে স্বীকার করলেন না। রঘুপতি সেনাপতিকে বিদ্রোহী করতে না পেরে প্রজাবিদ্রোহ করার চেষ্টা করতে লাগলেন। প্রজাদের দ্বারা মন্দির-রক্ষার ব্যবস্থা করে রঘুপতি বলি দিয়ে দেবীর পূজার আয়োজন করতে লাগলেন। গোবিন্দমাণিক্য সেখানে উপস্থিত হয়ে বলি বন্ধ করে সেনাপতি নয়নরায়কে আদেশ করলেন মন্দির রক্ষা করতে। সেনাপতি নয়নরায় রাজার আদেশ পালন করতে অক্ষম এ কথা রাজাকে বিনীত ভাবে জানালেন। তখন রাজা নয়নরায়কে সেনাপতির পদ হতে অপসারিত করে চাঁদপালকে সে পদ দিলেন। ২য় অঙ্কে মন্দিরে রঘুপতি, জয়সিংহ ও নক্ষত্ররায়। রঘুপতি নিজের সঙ্কল্পসিদ্ধির উদ্দেশ্যে নক্ষত্ররায়কে কপট প্রতারণায় প্রলুব্ধ করার জন্য মিথ্যা করে বললেন— কাল রাত্রে স্বপন দিয়েছে দেবী, তুমি হবে রাজা। নক্ষত্ররায় একটু অল্পবুদ্ধি, সে জানতে চাই যে রাজা হবেন? রঘুপতি তাকে বললেন-- আগে রাজরক্ত আনতে হবে,--দেবী রাজরক্ত চান। নক্ষত্ররায় বললেন--রাজরক্ত পাব কোথা? এবার রঘুপতি স্পষ্ট করে বললেন যে, বাড়ীতেই তো রাজা আছেন গোবিন্দমাণিক্য, তারই রক্ত দেবী চান। এ কথা শুনে জয়সিংহ স্নেহের অনুযোগ করে দেবী-প্রতিমাকে বললেন— তুই রাক্ষসী পাষাণী বটে, মা আমার রক্ত-পিয়াসিনী! রঘুপতির কাছে তিনি আবার জিজ্ঞাসা করিলেন যে সত্যই কি দেবী রাজরক্ত চান, তবে তিনিই সে রাজরক্ত দিবেন।একদিন চাঁদপাল এসে রাজাকে সংবাদ দিল যে সে নিজকানে শুনেছে রঘুপতি ও যুবরাজ নক্ষত্ররায় মিলে রাজাকে হত্যা করার পরামর্শ করেছেন, এবং নক্ষত্র দেবতার কাছে রাজরক্ত এনে দিবেন বলে কথা দিয়েছেন। রাজা বললেন— জানিয়াছি দেবতার নামে মনুষ্যত্ব হারায় মানুষ। অন্যদিকে দুর্বলচিত্ত জয়সিংহ নিজের প্রাণদান করে মুক্তি পেতে চান কিন্তু রঘুপতি তো জয়সিংহের প্রাণ চান না, তিনি তাকে প্রাণদণ্ডের অপেক্ষা গুরুতর দণ্ড দিবেন বলে দেবীর চরণ স্পর্শ করে শপথ করায়ে বলতে বাধ্য করলেন— আমি এনে দিব রাজরক্ত, শ্রাবণের শেষ রাত্রে, দেবীর চরণে। নক্ষত্ররায় ও রঘুপতি নিদ্রিত ধ্রুবকে চুরি করে মন্দিরে হত্যা করতে এনেছেন রাণীর প্ররোচনায় নক্ষত্র যুবরাজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে ধ্রুবকে হত্যা করতে উদ্যত, আর রঘুপতি রাজার প্রিয়পাত্র বালককে হত্যা করে রাজাকে কষ্ট দিতে পারবেন এ আশায় কিন্তু রঘুপতি এ শিশুকে দেখে তার পালক-পুত্র জয়সিংহের শৈশব মনে পড়ায় তার প্রতি মমতা জেগে উঠলো। রঘুপতি সচেতন হয়ে দেখলেন রাজা উপস্থিত তাই হঠাৎ খড়গ উঠালেন, প্রহরিগণ এসে রঘুপতি ও নক্ষত্ররায়কে বন্দী করিলেন। শ্রাবণের শেষ রাত্রি। রঘুপতি রাজরক্তের জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। তিনি জয়সিংহের আগমন প্রতীক্ষা করছেন। জয়সিংহ বললেন- রাজরক্ত তার ধমনীতেই আছে, তারা রাজপুত, তার পূর্বপুরুষ রাজা ছিলেন- রাজরক্ত আছে এই দেহে! এই রক্ত দিব! এই যেন শেষ রক্ত হয় মাতা! এই রক্তে যেন শেষ মিটে যায় তোর সমস্ত পিপাসা! এ উক্তি করে জয়সিংহ ছুরি দ্বারা আত্মোত্সর্গ করলেন। জয়সিংহকে আত্মহত্যা করতে দেখে রঘুপতির স্নেহসন্তপ্ত হৃদয় হাহাকার করে উঠিল।অপর্ণা জয়সিংহকে মৃত দেখে মুর্ছা গেল। রঘুপতি এতদিনের ভ্রান্তি হতে মুক্ত হয়ে দেবীপ্রতিমাকে গোমতী নদীর জলে নিক্ষেপ করলেন। গুণবতী পূজা নিয়ে মন্দিরে এসে দেখলেন দেবী নাই। তিনি মনে করলেন, দেবী বুঝি উপযুক্ত পূজার অভাবে রেগে মন্দির পরিত্যাগ করেছেন। তিনি রঘুপতিকে জিজ্ঞাসা করলেন-কোথা দেবী? উত্তরে রঘুপতি বললেন— দেবী বলো তারে? পূণ্য রক্ত পান করে সে মহারাক্ষসী ফেটে মরে গেছে। অপর্ণা নিজের হৃদয় দিয়া বুঝল যে, আজ রঘুপতি কী দারুণ আঘাতে ব্যথিত হয়েছেন। সেজন্য রঘুপতির প্রতি আজ তার হৃদয়ের অনুকম্পার শেষ নাই। রঘুপতি অপর্ণার কণ্ঠে পিতৃসম্বোধন শুনে পুনরায় স্নেহের আস্বাদ পেলেন এবং মনে করলেন জয়সিংহই অপর্ণার কণ্ঠে এই স্নেহসম্বোধন রেখে গেছে। রাজা ফুল নিয়ে দেবাবে দেবীকে শেষ পূজা দিতে আসলেন এবং দেবীপ্রতিমার তিরোধান ও মন্দিরে রক্তধারা দেখে বিস্মিত হলেন। রঘুপতি রাজাকে বললেন— এই শেষ পূণ্য রক্ত এ পাপ মন্দিরে! রাণী গুণবতী এসে রাজাকে সম্বোধন করে বললেন-- আর দেবী নাই--তুমি মোর একমাত্র রয়েছে দেবতা! গুণবতী এতদিনের কুসংস্কার হতে বিমুক্ত হয়ে এখন প্রেমের আশ্রয়ে আত্মসমর্পণ করলেন। রাজা বললেন— গেছে পাপ! দেবী আজ এসেছে ফিরিয়া আমার দেবীর মাঝে। পাপ কুসংস্কার হিংসা দ্বেষ মুছে গেল। প্রকৃত যিনি দেবী তিনি তো প্রেমময়ী, তিনিই আজ মহারাণীর গভীর প্রেমের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করলেন। রঘুপতিও অনুভব করলেন- পাষাণ ভাঙিয়া গেল--জননী আমার এবারে দিয়াছে দেখা প্রত্যক্ষ প্রতিমা! জননী অমৃতময়ী? এখানে বিসর্জন সম্পূর্ণ হল--মিথ্যা দেবীপ্রতিমার বিসর্জন হল, জয়সিংহের ন্যায় মহাপ্রাণের বিসর্জন হল, রঘুপতির ন্যায় বলিষ্ঠ উন্নত হৃদয় হতে কুসংস্কার ও হিংসার বিসর্জন হল, রাণীর ভ্রমের বিসর্জন হল, রাজা ও রাণীর মধ্যেকার বিদ্রোহের বিসর্জন হল।
Next Post Previous Post