উলঙ্গ রাজা | অপু চন্দ্র বর্মন
❝উলঙ্গ রাজা❞
অপু চন্দ্র বর্মন
রাজা চলেন রাজপথে, ভরে গৌরব দৃষ্টি,
পিছনে তার চাটুকারের শ্রদ্ধায় গাঁথা সৃষ্টি।
মাথায় মুকুট, হাতে রাজদণ্ড, মুখে তেজের হাসি,
কিন্তু গাত্রে বসন নাই, উলঙ্গ দেহ ভাসে।
জনতার কণ্ঠে উঠিল ধ্বনি, “জয় হোক, জয় হোক হে রাজা!”
চরণতলে চুম্বন করে, কহে—“এ বসন সত্যসাজা!”
চক্ষু যাহা দেখে না গো, বুদ্ধি তাহা মানে,
মোহের দ্যুতি ঢাকিয়াছে বিবেকের সকল জানে।
কে যেন বলে, “ইহা বসন, আলোক-তন্তু বোনা,
জ্যোৎস্না পড়ে শরীরে যেমন, ছুঁয়েও যেন না ছোঁওয়া!”
আরেক জন কহে, “অদৃশ্য এ বস্ত্র বড় চমৎকার,
শুধু জ্ঞানীর চক্ষু দেখে, মূর্খের নয় অধিকার।”
রাজা শুনে গর্বভরে চলেন সম্মুখপানে,
অহমিকার প্রদীপ জ্বলে উলঙ্গ হৃদয়খানে।
ভ্রূ কুঁচকায় প্রজাসভা, তথাপি মুখে হাসি,
ভয়ে ভয়ে চাপিয়া রাখে মনের সত্যবাসি।
একটি শিশু ছুটে এসে প্রশ্ন করে বাণী—
“রাজা কেন নগ্ন চলে? কই তার গায়ে বস্ত্র জানি?”
স্তব্ধ হয়ে যায় চতুর্দিক, থেমে যায় করতালি,
প্রবাহহীন নদীর মত নেমে আসে নিস্তব্ধ খালি।
কেউ বলে, “এ কথা নিষেধ, শিশুটি অবুঝ বটে”,
কেউ বলে, “সত্যটা বলিল, এ যে মহা বিপদ ঘটে।”
তবু শিশুর মুখে হাসি, চোখে অমল দীপ্তি,
সে যে জানে, সত্য বলায় নাই কোনো ভক্তি।
রাজ্য জুড়ে মুখোশ পড়া, মিথ্যার গহন ছায়া,
চাটুকারের সভায় সত্য হারায় বারো মাসে, দ্বাদশ পায়া।
ভয়ে সবাই করতালি দেয়, মনে পুড়ে ভয়,
রাজা যাহা বলে, তাহাই বুঝি নূতন ধর্ম হয়।
রাজা যেন সাপ—নির্বিষ বটে, তবু ফণী খাড়া,
তারে দেখে সবাই থেমে যায়, জিভে কথা সাড়া।
বজ্রগম্ভীর হুঙ্কারে বলে—“আমিই ধর্মমূর্তি,”
নিজের দেহে নিজেই বাঁধে নকল ধর্মসূত্রি।
তার রাজসভা অপবিত্র, দেহ তার নাঙ্গা নর,
তবু লোকের ভয়ে সত্য কাঁপে, নতজানু চর।
কোনো এক ঘরে ফিসফাস হয়, “এই পথ ভুল ঠিক নয়,”
তবু বাইরে এসে ঠোঁটেই পড়ে প্রসন্ন মিথ্যের বই।
পুঁথির পাতায় সত্য লেখা, কাগজ জানে মানে,
কিন্তু যখন বলিতে যায়, ঢাকে চাটুকারের টানে।
বিপদের আশঙ্কায় মানুষ ভুলে আপন মুখের ছবি,
হৃদয়ের ভাষা গোপন রাখে, মুখে দেয় সোনার রবি।
রাজা চলে, হাওয়ায় ওড়ে—মিথ্যার এক শাড়ি,
পিছনে বাজে স্তব ও শ্লোক, অন্ধ জনতার পাড়ি।
কিন্তু কোথাও, কোন গৃহে, শিশুরা খেলে খেলে
বলছে—“রাজা উলঙ্গ বটে, হাসি চেপে চলে চেলে।”
একদিন আলো ফুঁড়ে আসবে সাহসী কণ্ঠস্বর,
সেই বালকের মত বলবে—“সত্য, সত্য, এবার জয় কর।”
মিথ্যা যত মুখোশ পরে, ধীরে ধীরে
গলে যাবে,
রাজা তখন বুঝবে, লজ্জা কাকে বলে—অন্তর কাঁপে, কাঁদে।