কালকেতু উপাখ্যান (আখেটিক খন্ড) (১৫৯৪-১৬০৬) কবি কঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (১৫২০-১৬০৬)
কালকেতু উপাখ্যান
(আখেটিক খন্ড)
(১৫৯৪-১৬০৬)
কবি কঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী
(১৫২০-১৬০৬)
নীলাম্বর স্বর্গে বেশ সুখে কাটাচ্ছিল। শিবের পুজোতে মনোনিবেশ করেছিলো নিজেকে। কিন্তু দেবী চণ্ডীর ইচ্ছায় নীলাম্বরের ভাগ্যাকাশে দুঃখের মেঘ দেখা দিলো। চণ্ডীর ইচ্ছে হয়েছে পৃথিবীতে তার পুজো প্রচারের। কিন্তু কে করবে তার পুজো প্রচার? চণ্ডী এ-কাজে মনে মনে নীলাম্বরকে মনোনীত করলো। চণ্ডী তার স্বামী শিবকে বললো, 'নীলাম্বরকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দাও, সে পৃথিবীতে আমরা পুজো প্রচার করবে। শিব বললো, বিনা অপরাধে আমি তাকে কী করে স্বর্গ থেকে বিদায় দিই? চণ্ডী মনে মনে পরিকল্পনা আটলো, সে নীলাম্বরকে পাঠাইবেই। একদিন শিবপুজোর জন্যে বাগানে ফুল তুলছিলো নীলাম্বর। চণ্ডী সেখানে গেলো, নিজেকে বিষাক্ত কীটে রূপান্তরিত করল, এবং নীলাম্বরের তোলা ফুলে গোপনে লুকিয়ে রইলো। ঘনিয়ে এলো নীলাম্বরের স্বর্গ থেকে বিদায়ের দিন। নীলাম্বর ফুল দিয়ে শিবপুজো করতে গেলে ফুলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কীট শিবকে দংশন করলো। কীটের কামড়ে শিউরে উঠলো শিব, অভিশাপ দিল নীলাম্বরকে, 'যাও, পৃথিবীতে গিয়ে জন্ম নাও ব্যাধ হয়ে।' শিবের অভিশাপে দেবতা নীলাম্বরের সব দেবত্ব বিলীন হয়ে গেলো। বেচারির নিজের কোন অপরাধ ছিলো না, তবুও দৈব দয়ায় তাকে চলে আসতে হল এ কষ্টভরা পৃথিবীতে। সে জন্ম নিলো ধর্মকেতু নামক এক ব্যাধের পুত্র হয়ে। অন্যদিকে তার স্ত্রী ছায়াও চ'লে এলো পৃথিবীতে অন্য এক ব্যাধের কন্যা হয়ে। নীলাম্বরের নাম হলো কালকেতু, আর ছায়ার নাম হলো ফুল্লরা। কাহিনীতে বর্ণিত হয়েছে চন্ডী মর্তের সর্বত্র নিজ পূজাকে প্রতিষ্ঠিত করতে ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বরকে শাপভ্রষ্ট করে ধর্মকেতু এবং নিদয়া ঘরে কালকেতু নাম ধারণ করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে এবং নীলাম্বরের সঙ্গিনী ছায়াকে পুনরায় তার সঙ্গিনী করে ফুল্লরা নামে পৃথিবীতে প্রেরণ করে । ফুল্লরার জন্মও হয়েছিল এক ব্যাধ গৃহে । তার পিতা সঞ্জয়কেতু এবং মাতা হীরা । এগার বছর বয়সে তার বিয়ে হয় কালকেতুর সঙ্গে ।।
কালকেতুর ভোজন'অংশে মুকুন্দরাম লিখেছেন—
মোচড়িয়া গোঁফ দুটা বান্ধিলেন ঘাড়ে।
এক শ্বাসে সাত হাঁড়ি আমানি উজাড়ে।।
চারি হাঁড়ি মহাবীর খায় খুদ জাউ।
ছয় হান্ডি মুসুরী সুপ মিশ্যা তথি লাউ।।
ঝুড়ি দুই তিন খায় আলু ওল পোড়া।
কচুর সহিত খায় করঞ্চা আমড়া।।
কালকেতু ব্যাধের ছেলে সুন্দর স্বাস্থ্যবান। বনের পশুরা তার জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠলো। তার বিয়ে হলো এগারো বছর বয়সে ফুল্লরার সাথে। পৃথিবীতেও তারা বেশ সুখে দিন কাটাতে লাগলো। কালকেতু ছিলো অসাধারণ শিকারী, তার নিক্ষিপ্ত শরে প্রতিদিন প্রাণ হারাতে লাগলো সংখ্যাহীন বনচর পশু। ছোটখাটো দুর্বল পশুদের তো কথাই নেই, এমনকি বাঘ-সিংহরাও ভীত হয়ে উঠলো। বনে পশুদের বাস করা হয়ে উঠলো অসাধ্য। পশুরা ভাবতে লাগলো কী করে রক্ষা পাওয়া যায় এ-শিকারীর শর থেকে। সব পশু একত্র হয়ে ধরলো তাদের দেবী চণ্ডীকে; বললো, বাঁচাও কালকেতুর শর থেকে। চণ্ডী বললো, বেশ শুরু হল চণ্ডীর চক্রান্ত। কালকেতুকে অস্থির ক'রে তুললো নানা ভাবে। কালকেতু জীবিকা নির্বাহ করে পশু মেরে। একদিন সে বনে গিয়ে দিখলো বনে কোন পশু নেই। চণ্ডী সেদিন ছল ক'রে বনের পশুদের লুকিয়ে রেখেছিলো। সেদিন কালকেতু কোন শিকার পেলো না, না খেয়ে তাকে দিন কাটাতে হলো। পরদিন আবার সে তীর ধনুক নিয়ে শিকারে গেলো। পথে দেখলো সে একটি স্বর্ণগোধিকা অর্থাৎ গুইসাপ। এ জিনিসটি অলক্ষুণে; তাই কালকেতু চিন্তিত হয়ে পড়লো রেগে উঠলো কালকেতু। সে গোধিকাটিকে বেধে নিলো। মনে মনে ভাবলো আজ যদি কোনো শিকার না মেলে তবে এটিকেই খাওয়া যাবে।
সেদিন কোন শিকার মিললো না তার। সে গোধিকাটিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে দেখলো তার প্রতীক্ষায় ব'সে আঠে ফুল্লরা। কিছু রান্না হয়নি। গতকাল তারা খেতে পায় নি, আজো খেতে পানে না। কালকেতুর শিকারহীন ফিরে আসতে দেখে প্রায় কেঁদে ফেললো ফুল্লরা। কালকেতুকে বললো, 'এ গোধিকাটিকে আজ রান্না করো, পাশের বাড়ির বিমলাদের থেকে কিছু খুদ এনে বাঁধ, আমি হাটে যাচ্ছি। এ বলে কালকেতু চ'লে গেলো।
তার পরেই এলো বিস্ময়, ঘটলো অভাবনীয় ঘটনা। গোধিকাটি আসলে ছিলো দেবী চণ্ডী। ফুল্লরা বিমলাদের বাড়িতে যেতেই সে এক অপরূপ সুন্দরী যুবতীর রূপ ধরণ করলো। বিমলাদের বাড়ি থেকে ফিরে এসে নিজের আঙ্গিনায় এক অপূর্ব সুন্দরী যুবতীকে দেখে অবাক হয়ে গেলো ফুল্লরা। সাথে সাথে হলো ভীতও। ফুল্লরা তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলো। দেবী চণ্ডী ছলনাময়ী, শুরু করলো তার ছলনা। সরলভাবে বললো, 'কালকেতু আমাকে নিয়ে এসেছে।'
একথা শুনে ভয় পেলো ফুল্লরা।এতোদিন সে স্বামীকে নিয়ে সুখে ছিল, ভাবলো এবার বুঝি তার সুখের দিন ফুরোলো। ফুল্লরা অনেক বুঝালো যুবতীটিকে। বললো, 'তুমি খুব ভালো, তুমি খুব সুন্দরী। তুমি তোমার নিজের বাড়িতে ফিরে যাও, নইলে মানুষ নানা কথা বলবে।' কিন্তু যুবতী ফুল্লরার কথায় কোনো কান দিলো না; বললো, 'আমি এখানে থাকবো।' এতে কেদে ফেললো ফুল্লরা, দৌড়ে চ'লে গেলো হাটে কালকেতুর কাছে। বললো সব কথা। শুনে কালকেতুও অবাক। সে বাড়ি ফিরে এলো ফুল্লরার সাথে, এবং যুবতীকে দেখে অবাক হলো। কালকেতু বার বার তাকে বললো, তুমি চলে যাও।কিন্তু কোনো কথা বলে না যুবতী। তাতে রেগে গেলো কালকেতু, তীরধনুক জুড়লো, যুবতীকে সে হত্যা করবে।যখন কালকেতু তীর নিক্ষেপ করতে যাবে তখন ঘটলো আরো বিস্ময়কর এক ঘটনা। এবার এবার চণ্ডী নিজের মুর্তিতে দেখা দিলো। সে আশ্চর্য সুন্দরী মেয়ে পরিণত হলো দেবী চণ্ডীতে। চোখের সামনে এমন অলৌকিক ব্যাপার দেখে ব্যাধ কালকেতু মুগ্ধ হয়ে গেলো। চণ্ডী বললো, তোমরা আমার পুজো প্রচার করো, আমি তোমাদের অজস্র সম্পদ দেবো। রাজি হলো কালকেতু-ফুল্লরা। অবশ্য দেবীর কথা প্রথমে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে নি ফুল্লরা, কেননা এ ছিলো অভাবিত। দেবী সাত সাথে সাত কলস ধন দান করলো।
মুকুন্দরাম চক্রবর্তী
কালকেতু জীবনে সোনা দেখেনি। সে সোনা লাভের পর সোনা বাঙ্গাতে যায় মুরারি শীলনামের এক বেণের কাছে। বেণে চতুর, কালকেতু বোকা। বেণে ভাবলো, দেখি না একটু বাজিয়ে যদি কালকেতুকে ঠকাতে পারি। তাই বেণে মুরারি শীল বললো,
“সোণা রূপা নহে বাপা এ বেঙ্গো পিতল।
ঘষিয়া মাজিয়ে বাপু করেছ উজ্জ্বল।”
মুরারি বলছে, এ সোনারূপো নয়, পেতল। তুমি ঘ'ষেমেজে উজ্জ্বল ক'রে এনেছো।
কালকেতু বললো, এ আমি দেবীর কাছে থেকে পেয়েছি। কবির ভাষায়:
"কালকেতু বলে খুড়া না কর ঝগড়া।
অংগুরী লইয়া আমি যাই অন্য পাড়া।”
তখন বেণের টনক নড়ে। সে তো চিনেছে এ-সোনার মতো সোনা হয় না তাই বেণে শেষে সোণা রেখে দেয়। কালকেতু পরে গুজরাটে বন কেটে নির্মাণ করে বিরাট নগর। কালকেতু হয় গুজরাটের রাজা আর ফুল্লরা হয় রাণী। সেখানে ছিলো ভাড়ুত্ত নামের এক দুষ্টু লোক। দুষ্টুরা মন্ত্রী হ'তে চায় চিরকালই, সেও এসে কালকেতুর মন্ত্রী হতে চাইলো। কালকেতু তাতে রাজি হলো না। এতে ভাড়ুদ্ত্ত ক্ষেপে গেলো। ভাঁড়ু নিজ কণ্ঠে ঈর্ষা প্রকাশ করেছে-
হরিদত্তের বেটা হঙ জয়দত্তের নাতি। হাটে যদি বেচাঙ বীরের ঘোড়া হাতি৷৷ তবে সুশাসিত হবে গুজরাট ধরা। পুনরপি হাটে মাংস বেচিবে ফুল্লরা।
সে চ'লে গেলো কলিঙ্গে, সেখানকার রাজাকে নানা কিছু বুঝিয়ে কালকেতুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে রাজি করালো। বেঁধে গেলো যুদ্ধ।
সে যুদ্ধ জানে না। তাই যুদ্ধে হেরে গেলো, এসে পালিয়ে রইলো, বউয়ের পরামর্শ মতো, ধানের গোলার ভেতরে। কলিঙ্গরাজ তাকে বন্দী ক'রে নিয়ে গেলো, কারাগারে কালকেতু স্মরণ করলো দেবী চণ্ডীকে।
চণ্ডী কালকেতুর ওপর সব সময় সদয়, কেননা কালকেতু তার ভক্ত। দেবী কলিঙ্গের রাজাকে স্বপ্ন দেখা দিলো। বললো, কালকেতু আমার ভক্ত তাকে মুক্তি দাও, তার রাজ্য ফিরিয়ে দাও। কলিঙ্গরাজ দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে মুক্তি দিলো কালকেতুকে, ফিরিয়ে দিলো তার রাজ্য। কালকেতু তার রাজ্য ফিরে এসে আবার রাজা হলো, রাজত্ব করতে লাগলো বেশ সুখে। ফুল্লরা তার সুখী রাণী। অনেক দিন রাজত্ব ক'রে বৃদ্ধ হলো কালকেতু আর ফুল্লরা, এবং এক শুভদিনে মহাসমারোহে আবার নীলাম্বর-ছায়ারূপে ফিরে গেলো স্বর্গে।